নবজাতক ও শিশু-কিশোরদের থায়রয়েড সমস্যা অনেক বেশি না হলেও অনেককেই থায়রয়েডজনিত সমস্যায় ভুগতে দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে শত শত বছর যাবত আয়োডিন ঘাটতির ইতিহাস আছে, সেখানে এ সমস্যাটির ব্যাপকতা আরও বেশি থাকার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে গর্ভকালীন সময়ে যদি মায়ের আয়োডিনের ঘাটতি থাকে তবে সন্তানের জন্মগত হাইপোথায়রযেডিজমের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ সমস্যা প্রকট। প্রতি ১৫০০ থেকে ২৫০০ জীবিত সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে একজন করে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। নাজমা বেগমের মতো যে মহিলারা হাইপোথায়রযেডিজমে ভুগছিলেন এবং সেটি যদি অটোইমিউন হাইপোথায়রয়েডিজম হয়ে থাকে, তাহলে তার সন্তানদের নবজাতকের হাইপোথায়রয়েডিজমে ভুগার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেকের থায়রয়েড গ্রন্থিটি মোটেও তৈরি না হওয়া বা অকার্যকরভাবে তৈরি হবার কারণে এ রোগ হচ্ছে। এদের ক্ষেত্রে এটি জিনগত ত্রুটি। এ ত্রুটিটি বাবা মা রক্তের সম্পর্কিত হলে, সেক্ষেত্রে সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে পারে। একই এলাকার, একই পরিবারের বহু মানুষ হাইপোথায়রয়েডিজমে ভোগেন। আর অটোইমিউন হাইপোথায়রয়েডিজম এক্ষেত্রে বেশি লক্ষ্যণীয়।
 
 

নবজাতকের হাইপোথায়রয়েডিজমের লক্ষণসমূহ

 
-খুব কম নড়াচড়া করা
-কান্নাকাটি কম করাবা কাঁদলে অনেকটা মিউ মিউ শব্দ হওয়া
-খাদ্য গ্রহণে আগ্রহ কম
-শরীরের বৃদ্ধিও খুব কম
-জন্ডিস হওয়া
-পায়খানা খুব কম হওয়া
-শরীর তুলতুলে বা খুব নরম হওয়া
-পেট খুব বেড়ে যাওয়া বা পাতিলের মতো হয়ে যাওয়া
-মাথার তালু নরম থাকা
-আনুপাতিক হারে বৃহদাকার জিহ্বা
-নাভী বেরিয়ে আসা (আমরিলিকাল হারনিয়া)
-শীতল খসখসে ও শুকনো ত্বক
-ফ্যাকাশে দেখানো
-গলগণ্ড বা ঘ্যাগ থাকা
-কিছুসংখ্যক নবজাতকের একই সঙ্গে আরো কিছু জন্মগত ত্রুটি থাকার সম্ভাবনা থাকে
 
তাদের এই কান্নাকাটি না করা, কম নড়াচড়া করা শুরুতে খুব ভাল বাচ্চার বৈশিষ্ট্য মনে করা হলেও দ্রুত এ ভুল ভেঙ্গে যায়। যে পরিবারের এ রকম রোগ ধরা পড়ে সে পরিবারের পূর্বের কোনো সন্তানেরও এ রোগ হয়ে থাকার ইতিহাস থাকতে পারে। যেসব বাচ্চাদের জন্মের সময় ওজন দুই হাজার গ্রামের কম বা চার হাজার পাঁচশ গ্রামের বেশি তাদের মধ্যে এ ধরনের রোগ থাকার সম্ভাবনা থাকা বেশি। আবার অধিক সন্তান প্রসবকারী মহিলার পরবর্তী দিকের সন্তানদের হাইপোথায়রয়েডিজম হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
 
জন্মগত বা নবজাতকের হাইপোথায়রয়েডিজম শনাক্ত করণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম স্ক্রিনিং বা শনাক্তকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে সাধারণত নিম্নলিখিত পদক্ষেপ সন্নিবিষ্ট থাকে।
১। জন্মের ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে নবজাতককে শনাক্তকরণ পদ্ধতির আওতায় আনা হয়।
২। শিশুটিকে খুব যত্নসহকারে তীক্ষ্মভাবে এবং দক্ষতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, যাতে হাইপোথায়রয়েডিজমের যে কোনো লক্ষণ থাকলে তা ধরা পড়ে যায়।
৩। এরপর শিশুটি ল্যাবরেটরি টেস্ট করা হয়। একটু বেশি বয়সী শিশু হলে তার বুদ্ধিমত্তার (আই কিউ) পরীক্ষা করা হয়।
 

কারণ

 
জিনগত ত্রুটি ছাড়া সবচেয়ে বড় কারণ হলো খাদ্যে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত এলাকায় বসবাস করা। এর সাথে যদি পরিবেশগত অন্য কোনো কারণ যোগ হয় তাহলে সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। থায়রয়েডের হরমোন তৈরিতে ব্যর্থতা, গ্রন্থির অস্বাভাবিকতা ইত্যাদিও থাকে। মাকে যদি গর্ভকালীন সময়ে রেডিও এক্টিভআয়োডিন থেরাপি দেয়া হয়, তাহলে গর্ভস্থ শিশু থায়রয়েড গ্রন্থি তৈরি না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
 
এ রোগটি শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া খুব সহজ। রক্তের নমুনা ও গলার আল্ট্রাসনোগ্রাম করেই নিশ্চিতভাবে নবজাতকের হাইপোথায়রয়েডিজম শনাক্ত করা যায়। উন্নত বিশ্বের প্রায় সব নবজাতকেরই হাইপোথায়রয়েডিজম আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু কম উন্নত (বাংলাদেশসহ) দেশগুলোতে অধিকাংশ নবজাতকের ক্ষেত্রে শনাক্তকরণের পরীক্ষাগুলো করা হয় না।
 
চিকিৎসা
 
যেসব নবজাতকের হাইপোথায়রয়েডিজম ধরা পড়বে তাদের লেভোথায়রক্সিন ট্যাবলেট দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। পরবর্তীতে থায়রয়েড হরমোনের কার্যকারিতা দেখে লেভোথায়রক্সিনের মাত্রা ঠিক করা হয়। জিনগত, গ্রন্থির ত্রুটি বা থায়রয়েড গ্রন্থির অনুপস্থিতির কারণে এ রোগ হয়ে থাকে- তাহলে রোগীটিকে আজীবন এবং বেশি মাত্রায় এ ওষুধটি সেবন করতে হয়। আর অন্য কারণগুলোতে কারও কারও ক্ষেত্রে কোনো এক সময় ওষুধ বন্ধ করার মতো পরিস্থিতিও হতে পারে।
 
চিকিৎসা পরবর্তী ফলাফল
যেসব নবজাতক/শিশুর রোগ দ্রুত শনাক্ত হবে এবং সঠিক মাত্রায় থায়রক্সিন দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া হবে, তাদের দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই হবে। কিন্তু রোগটি শনাক্তকরণে দেরি হলে অথবা সঠিকভাবে চিকিৎসা করা না হলে নবজাতক/শিশুটির দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। মানসিক বৃদ্ধিও ঠিকমতো হবে না। সারা পৃথিবীতে যত কম বুদ্ধিসম্পন্ন বা হাবা-গোবা লোক আছে তাদের একটা বড় অংশই বৃদ্ধিকালীন হাইপোথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত ছিল বা সঠিকভাবে চিকিৎসা পায়নি।
 
শিশু-কিশোদের হাইপোথায়রয়েডিজম
 
শিশু-কিশোররা সাধারণত দু’রকম হাইপোথায়রয়েডিজমে ভোগে-
১। জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজম: (উপরে আলোচিত হয়েছে)।
 
২। পরবর্তী সময়ে সংঘটিত হাইপোথায়রয়েডিজম:
এ ধরনের হাইপোথায়রয়েডিজম সাধারণত বয়োসন্ধিকালের আগে আগে বা বয়োসন্ধিকালের কাছাকাছি কোন সময়ে শুরু হয়। বাংলাদেশের ৭৫০ জন শিশুর মধ্যে এ রোগে ১ জন আক্রান্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১২৫০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন এ রোগে ভোগে; যা তাদের ১২ বছর বয়সী মোট শিশুর ৪.৬ শতাংশ।
 
শারীরিক বহুবিধ প্রয়োজনে থায়রয়েড হরমোন অতীব জরুরি। যেমন- শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি, শিশুর হাড়ের গঠন তৈরি এবং বিপাকীয় কার্যক্রম।
 
প্রায় সব দেশেই শিশু-কিশোররা অটোইমিউন হাইপোথায়রয়েডিজমে ভোগে। এক্ষেত্রে দেহের রোগ প্রতিরোধী কার্যক্রম (ইমিউন সিস্টেম) থায়রয়েড গ্রন্থির কোষগুলোকে আক্রমণ করে; যাতে প্রদাহ তৈরি হয় এবং থায়রয়েড গ্রন্থির ক্ষমতা হ্রাস করে থাকে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে পিটুইটারির কার্যক্রম কমে যাওয়ার কারণে বা কোনো কোনো ওষুধের কারণে হাইপোথায়রয়েডিজম হতে পারে। ডাউনসিনড্রোমের মতো কিছু কিছু জন্মগত রোগেও শিশুদের হাইপোরয়েডিজমে ভুগতে দেখা যায়।
 

লক্ষণসমূহ

 
দৈহিক বৃদ্ধি কম বা বামুনত্ব বা বৃদ্ধির হার ধীর, দেহের তূলনায় হাত-পা খর্বাকৃতি হওয়া, স্থায়ী দাঁত উঠতে বিলম্ব হওয়া, লেখাপড়ায় খারাপ হওয়া, অমনোযোগী বা মনোসংযোগে ব্যর্থ হওয়া, বুদ্ধিমত্তায় ঘাটতি প্রদর্শিত হওয়া, দৈহিক দুর্বলতা, মুখ ফোলা ফোলা লাগা, দৈহিক স্থুলতা, ঘুমের সমস্যা, বেশি ঠাণ্ড লাগা বা জ্বর জ্বর বোধ করা, চুল ভঙ্গুর হওয়া, নারীর প্রতি ধীর, গলগণ্ড বা ঘ্যাগ, মাংস বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, যৌবন প্রাপ্তিতে বিলম্ব।
 
উপরিউক্ত লক্ষণ থাকলে শিশুকে অতি দ্রুত একজন হরমোন বিশেষজ্ঞকে (এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট) দেখানো জরুরি। তিনি শিশুটির রক্তের নমুনা নিয়ে থায়রয়েড ও হরমোন পরিমাপের ব্যবস্থা করবেন। অনেক ক্ষেত্রেই গলার আল্ট্রাসনোগ্রাম দরকার হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রমজোমাল, জেনেটিক বা আপটেক টেস্ট করতে হতে পারে।
 
প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি হলো- থায়রক্সিন ট্যাবলেট দেওয়া। এক্ষেত্রে এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট শিশুটির হরমোনের ঘাটতির মাত্রা, হাইপোথায়রয়েডিজমের কারণ, শিশুর বর্তমান অবস্থা- সবই বিবেচনা করবেন। যত আগে চিকিৎসা শুরু করা যাবে শিশুটির স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা তত কম হবে।
 
ডা. শাহজাদা সেলিম
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়